টর্টের সংজ্ঞা , টর্ট এবং চুক্তিভঙ্গের মধ্যে পার্থক্য
প্রশ্ন: টর্টের সংজ্ঞা দাও। টর্ট এবং চুক্তিভঙ্গের মধ্যে পার্থক্যগুলো নিরূপণ কর ।
টর্টের সংজ্ঞা
ল্যাটিন শব্দ টর্টাম হতে টর্ট শব্দটির উত্পত্তি ঘটেছে , যার আভিধানিক অর্থ হলো বাঁকা। ইংরেজি ভাষায় টর্ট এর প্রতিশব্দ হচ্ছে Wrong এবং রোমান ভাষায় বলা হত Delicit উল্লেখ্য যে বাংলা ভাষায় সবার জন্যে ব্যবহার যোগ্য টর্টের কোন সর্বসম্মত প্রতিশব্দ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলা ভাষায় টর্টকে কেউ 'দেওয়ানী ক্ষতি' কেউ বা নিম চুক্তি আবার কেউ কেউ তাকে ব্যক্তিগত অপকার হিসেবে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু নিয়ত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিগত কারণে আজ পর্যন্ত টর্টের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভব হয়নি। তথাপি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিতা, মতবাদ ''Alterium non laedere'' এর উপর ভিত্তি করে আধুনিক যুগের টর্ট আইন সৃষ্টি হয়েছে, উক্ত মতবাদের অর্থ ছিল কাজে কিংবা কথায় কারো ক্ষতি না করা। এই সামাজিক কর্তব্য ভঙ্গ করে কেউ কোন ব্যক্তির ক্ষতি করলে আইনগত সে দায়ী বলে গণ্য হবে। টর্ট আইনের পরিধি হলো উপযুক্ত ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া এবং উক্ত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা। কিন্তু এতদসত্বেও বিভিন্ন মনীষী প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করা আবশ্যক। ফ্রেজারের মতে, টর্ট হলো ব্যাক্তি বিশেষের অধিকারকে খর্ব করা, যা ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে মামলা দায়েরের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়ের অধিকার প্রদান করে থাকে।' আবার ক্লার্ক এবং লিন্ডসেলের ভাষ্য মতে চুক্তি ছাড়া কোন অপকার হলো টর্ট বা বৃটেনের সাধারণ আইন দ্বারা প্রতিকারযোগ্য।
তদুপরি স্যার ফ্রেডারিক পোলক টর্টের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, টর্ট হলো এরূপ কাজ করা কিংবা করা হতে বিরত থাকা যা আইনের দ্বারা সমর্থিত নয় এবং যা চুক্তির সম্পর্কবিহীন।
টর্ট এবং চুক্তিভঙ্গের মধ্যে পার্থক্য:
টর্টের অপরাধ করা কিংবা চুক্তিভঙ্গ করা উভয়েই চোখে অন্যায়। অবশ্য এ জাতীয় অন্যায় ফৌজদারী অপরাধের আওতায় পড়ে না, তা দেওয়ানী প্রকৃতির হয়ে থাকে। উনবিংশ-বিংশ শতাব্দির পূর্ব পর্যন্ত চুক্তিভঙ্গ এবং টর্টকে একই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হতো। কিন্তু সামপ্রতিককালে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণের ভিত্তিকে কেন্দ্র করে টর্ট এবং চুক্তিভঙ্গ স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। তদুপরি টর্ট এবং চুক্তিভঙ্গের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করলে তাদের উভয়ের মধ্যে নিম্নবর্ণিত পার্থক্যসমূহ পরিলক্ষিত হয়:-
(১)চুক্তি ছাড়া আইনে প্রতিকারযোগ্য ব্যক্তিগত অপকর্মের নামই হলো টর্ট। পক্ষান্তরে, চুক্তি হলো পক্ষদের মধ্যে সম্পাদিত অঙ্গীকার যা আইনে বলবত্ হবার যোগ্যতা রাখে উক্ত অঙ্গীকার পালনের ব্যর্থতাই হলো চুক্তিভঙ্গ,যার জন্যে আদালতের দ্বারা প্রতিকার পাওয়া যায়।
(২) টর্টের ক্ষেত্রে অপরাধ যে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে পারে। ফলে টর্ট অপরাধ সংঘটনকারী এবং ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির মধ্যে কোন আইনগত সম্পর্ক থাকে না। তাই বলা যায় যে, টর্টের ক্ষেত্রে যে কর্তব্য লংঘণ করা হয় তা সার্বজনীন এবং পক্ষান্তরে, চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে অনুরূপ কর্তব্য কেবলমাত্র চুক্তিভঙ্গ পক্ষদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তাই উক্ত কর্তব্য লংঘনের ফলে চুক্তিভঙ্গের প্রতিকার পেতে হলে তাদের উভয়পক্ষের মধ্যে আইনগত সম্পর্ক থাকা অপরিহার্য।
(৩) যে কোন ব্যক্তিই টর্টের অপরাধ করুক না কেন ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারবে। পক্ষান্তরে, চুক্তিভঙ্গের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করতে হলে তা চুক্তিভুক্ত পক্ষদের মধ্যেই হতে হবে।
(৪) কোন কোন ক্ষেত্রে টর্টের মামলার ক্ষেত্রে মোটিভ বিচার্য বিষয় হতে পারে। পক্ষান্তরে, চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে মোটিভ বিচার্য বিষয়রূপে কোনভাবেই গণ্য হয় না।
(৫) টর্ট অপরাধ সংঘটন করার প্ররোচনা দেবার জন্য প্ররোচনাকারীর বিরুদ্ধে টর্টের আওতায় কিংবা চুক্তিগত প্রতিকারের দ্বারা ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে, সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই যে, টর্ট অপরাধের প্ররোচনাকারীর বিরুদ্ধে টর্টগত প্রতিকার পাওয়া না গেলেও চুক্তিভঙ্গের প্ররোচনাকারীর বিরুদ্ধে টর্টের প্রতিকার পাওয়া যায়। আর অনুরূপ টর্টেরই নাম'চুক্তিভঙ্গে প্রলুব্ধকরণ'।
(৬) সাধারণ আইনের বিধান দ্বারাই টর্টের দায়-দায়িত্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে, চুক্তিভঙ্গ পক্ষদের সম্মতির উপরেই চুক্তিভঙ্গের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়।
(৭) টর্টের ক্ষেত্রে যেমন ব্যক্তি সাধারণের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয় তেমনি চুক্তিভঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়ে থাকে।
(৮) কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে কোন কাজে প্রবৃত্ত হলে তা অসতর্কতার দরুণ জন্য কোন ব্যক্তির ক্ষতিসাধিত হলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে টর্টের মামলা দায়ের করা হয়। পক্ষান্তরে, কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অপরের চুক্তিগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে সেই ব্যক্তি চুক্তিগত কোন পক্ষনয় বলে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের করা যাবে না।
(৯) টর্টগত অপরাধের জন্যে সাধারণত: নাবালকের ও দায়ী করা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, কোন নাবালক আইনগত চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না বলে চুক্তিভঙ্গের জন্য নাবালককে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা যায় না।
(১০) সাধারণত টর্টগত প্রতিকারের ক্ষেত্রে অনির্ধারিত আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়ে থাকে। যদিও এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ ব্যতীত অন্যান্য প্রতিকারেরও ব্যবস্থা রয়েছে। পক্ষান্তরে, চুক্তিভঙ্গের জন্যে প্রতিকার হলো নির্ধারিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ যা সাধারণত চুক্তিতেই নির্দিষ্ট থাকে। তবে এক্ষেত্রে কখনও কখনও শাস্তিমূলক ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থাও থাকে। আবার কতিপয় ক্ষেত্রে চুক্তিভঙ্গ একই সঙ্গে টর্ট হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোন সার্জারীর ডাক্তার অপারেশন করার সময় যদি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করায় পেটের ভেতর গজ ব্যান্ডেজ থেকে যায় এবং তার ফলে রোগীর ক্ষতি হয় তাহলে চুক্তিভঙ্গ এবং অবহেলার (যা একটি টর্টগত অপরাধ) জন্যে উক্ত ডাক্তারকে দায়ী হতে হবেl
No comments